পেন্সিল কাহিনী

রাজে’র বলা গল্পটি

হারিয়ে যাওয়া টুকরো’টি

পওলো’র ভাবনা এবং আয়না   

ভাস্বতী সেনগুপ্ত এবং কিরীটি সেনগুপ্ত

লেখক পরিচিতির প্রথম বাক্যটিতেই আটকে গেলাম। লেখা আছে, “পওলো কোয়েলো ইজ এন এনচ্যান্টিঙ্ স্টোরীটেলার”। বাংলায় অনুবাদ করতে হলে লিখতে হয়, পওলো কোয়েলো মনোমুগ্ধকর একজন গল্প-বলিয়ে। নাহ্, ঠিক শোনাচ্ছে না। যদি বলি, পওলো কোয়েলো চমৎকার গল্প বলেন – শব্দ ধরে ধরে অনুবাদ হচ্ছে না ঠিক কিন্তু মূল লেখাটির রস এবং ভাব দুই’ই অক্ষুণ্ণ থাকল। দলছুট-এর মৃগাঙ্ক যেদিন প্রস্তাব দিলেন পওলো কোয়েলো’র রচনা অনুবাদ করে দিতে হবে, বারবার একটি চিন্তা’ই ঘুরে ফিরে এসেছে। অনুবাদ করে দেওয়া যায় কিন্তু মূল রচনার ভাবরস নষ্ট হলে পরিশ্রমটাই কেবল জলে যাবে তা নয়, পাঠককুল এবং সর্বোপরি মূল রচয়িতার প্রতি চূড়ান্ত অবিচার হবে। খেয়াল রাখতে হবে পওলো কোয়েলো’র অধিকাংশ রচনা পর্তুগীজ ভাষায়, পরবর্তীতে তার ইংরাজি অনুবাদ হয়েছে। আর সেই ইংরাজি অনুবাদ-রচনা’ই আমাদের চলার পাথেয়।

হাতে নিলাম পওলো’র ঝকঝকে নতুন বই, “লাইক দ্য ফ্লোয়িং রিভার”, ইংরাজিতে অনুবাদ করেছেন মারগারেট জুল্ কস্টা।

পেন্সিল কাহিনী

ঠাকুমা চিঠি লিখছেন আর তাকিয়ে আছে ছোট ছেলেটা। কৌতুহলী স্বর বেজে উঠল, “কি লিখছ, ঠাম্মা ? আমার কথা ?” লেখা থামিয়ে ঠাকুমা বললেন, “হ্যাঁ দাদুভাই, তোমাকে নিয়েই লিখছি”। “কি লিখছ ?” ঠাকুমা বললেন, “কি লিখছি বলব কিন্তু তার আগে এই পেন্সিলটার কথা বলি, জানো তো এটা একটা খুব দামী জিনিস। তুমি যখন বড় হবে আশা করি তুমিও এই পেন্সিলটার মতোই হবে”।

কৌতুহলী চোখ সময় নিয়ে দেখল পেন্সিলটা, তারপর অবাক প্রশ্ন, “এটা তো আর সব পেন্সিলের মতোই ?”

“অনেক কিছুই খুব সাধারণ দেখতে হয়, দাদুভাই কিন্তু তার ভিতরে কিছু কিছু অসাধারণ গুণ থাকে, তেমনি পেন্সিলটারও পাঁচটা বিশেষ গুণ আছে।  তুমি যদি এই গুণগুলো গ্রহণ করতে পার আমি নিশ্চিত যে তুমি সবসময় সবার সঙ্গে শান্তিতে থাকবে”।

“কি গুণ আছে বল ?”

“দ্যাখো দাদু, তোমার নিজের মধ্যে অনেক বড় কিছু করার ক্ষমতা আছে তবুও সবটাই তোমার হাতে নয়। যেমন এই পেন্সিলটাকে আমরা চালাই, তেমনই ঈশ্বর আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছেন। আমরা তাঁর ইচ্ছেতেই সবসময় চলি। এই বিশ্বাসটা রেখো”।

ঠাকুমা পেন্সিলটা রেখে শার্পনার্  হাতে নিলেন। “ভোঁতা পেন্সিল দিয়ে ভালো লেখা যায়, দাদু ?”

“কই না তো।”

“হ্যাঁ সেইজন্যেই আমরা মাঝেমাঝে পেন্সিল শার্প্ করি তো ? তাতে কিন্তু পেন্সিলটা কষ্ট পায়। ঠিক তেমনই তোমাকেও বড় হওয়ার পথে কষ্ট পেতে হবে, কষ্ট সহ্য করতে হবে। তবেই তোমার গুণ বাড়বে”।

“আচ্ছা ... আর কি গুণ আছে ঠাম্মা পেন্সিলটার ?”

“জানো তো, পেন্সিলে লেখার একটা সুবিধা হচ্ছে, কোন ভুল থাকলে দরকার মতো তুমি মুছে নিতে পার। তার মানে নিজের ভুল নিজে শুধরে নেওয়াটা খুব জরুরী, তাতে কোন লজ্জা নেই বরং আত্মসম্মান বাড়ে”।

“পেন্সিলটা একটু দেবে, ঠাম্মা ?” কৌতুহলী চোখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আবারও প্রশ্ন, “আচ্ছা আর দু’টো গুণ বলো তো”।

“যেমন ধরো দ্যাখার কথা; পেন্সিলের বাইরের ওই কাঠের খোলটা দেখো না ভাই, ওর ভিতরে যে কালো গ্রাফাইট আছে সেটি বড় দামী জিনিস। মানে, প্রত্যেকটি মানুষের ভিতরের ভাল গুণ গুলো তাকে বিশেষ মানুষ করে তোলে”।

“আর একদম শেষ গুণটা কি বলো তো ? পেন্সিল সবসময় দাগ রেখে যায়। তেমনই তোমারও সব কাজের চিহ্ন থেকে যাবে। নিজের সব কাজের প্রতি সৎ থাকবে”।

“তাহলে পেন্সিলের মতোই হব, ঠাম্মা”।

 রাজে’র বলা গল্পটি

বাংলাদেশের খুব গরীব গ্রামে এক অসহায় বিধবা মা ও তার ছেলে থাকতো । ছেলের স্কুল যাতায়াতের বাস ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্যও ছিল না। স্কুল যাওয়ার পথে একটা গভীর জঙ্গল ছিল, একলা সেই পথে যেতে ছেলেটি ভয় পেত। অসহায় মা অভয় দিয়ে বলেছিলেন, “ভয় কি বাবা ? জঙ্গলে তোর কৃষ্ণ দাদা থাকে, প্রাণভরে ডাকবি। সেইই তোকে নিয়ে যাবে, কোনো বিপদ হবে না”।

ছেলেটি ওর মায়ের কথা মতো মনে মনে কৃষ্ণ’কে ডাকল। যথা সময়ে কৃষ্ণ হাজিরও হলেন। সেই থেকে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় কৃষ্ণ ওর সঙ্গী হতেন।

স্কুলে মাস্টারমশাইয়ের জন্মদিন উপলক্ষে ছেলেটি ওর মায়ের কাছে কিছু টাকা চাইল। উপহার তো দিতেই হয়।

“আমার কাছে উপহার কেনার মতো টাকা নেই, বাবা। তুই তোর কৃষ্ণ দাদাকে বলিস, সে ঠিক একটা উপায় করবে”।

পরদিন ছেলেটি কৃষ্ণ দাদাকে তার প্রয়োজনের কথা বলল। কৃষ্ণ তখন হেসে তার হাতে একটি দুধ ভর্তি বোতল দিলেন।

নিশ্চিন্ত ও খুশী মনে ছেলেটি মাস্টারমশাইয়ের হাতে তুলে দিল তার উপহার। কিন্তু অন্যান্য ছেলেরা অনেক দামী এবং আকর্ষণীয় উপহার নিয়ে এসেছিল তাই ছোট্ট দুধের বোতলটি মাস্টারমশাইয়ের কাছে গুরুত্ব পেল না। একজন সহকারীকে বললেন, “দুধের বোতলটি রান্নাঘরে নিয়ে যাও”।

সহকারী রান্নাঘরে এসে দুধটা ঢেলে রাখলেন। কিন্তু পরক্ষণেই দেখলেন দুধের বোতল আগের মতনই ভর্তি। উনি মাস্টারকে বিষয়টা জানালেন। মাস্টারও অবাক, ছেলেটিকে ডেকে নিয়ে বললেন, “তুমি এই বোতল পেয়েছ কোথায় আর এটা সবসময় ভর্তি থাকছেই বা কি ভাবে ?”

“জঙ্গলে থাকে আমার কৃষ্ণ দাদা দিয়েছে”।

মাস্টারমশাই, তার সহকারী এবং অন্যান্য ছাত্ররা হেসে উড়িয়ে দিল,“এমন কেউ জঙ্গলে আছে আমরা তো জানি না। তুমি নিশ্চয়ই মিছে বলছ।  সত্যিই যদি এমন কেউ থাকে চলো আমাদেরকে দ্যাখাও”।

সকলে মিলে এসে পৌঁছলো জঙ্গলে। ছেলেটি তার কৃষ্ণ দাদাকে ডেকেই চলেছে তবু কেউই এলো না। ছটফট করতে করতে শেষবারের মতো বলল, “কৃষ্ণ দাদা, আমার মাস্টারমশাই তোমাকে দেখতে চান। তুমি এসো”। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, গমগম করে উঠল জঙ্গল।

“উনি আমাকে দেখতে পাবেন কি করে, আমার অস্তিত্ব তো ওনার বিশ্বাসে নেই”।

** অনুবাদকের মন্তব্য: এই গল্পটিতে আমাদের খুব পরিচিত একটি গল্প-কথা, “মধুসূদন দাদার দইয়ের ভাঁড়”-এর ছায়া পেলাম।

হারিয়ে যাওয়া টুকরো’টি

আমার সেক্রেটারির ফ্যাক্স’টা যখন এলো, আমি আর আমার স্ত্রী আমাদের সাপ্তাহিক ভ্রমণে ছিলাম। সেক্রেটারি জানিয়েছিল – আমাদের রান্নাঘর রেনোভেশনে একটা সমস্যা হচ্ছে। আমার স্ত্রী’র করা ডিজাইন অনুযায়ী যে ক’টি গ্লাস টাইলসের দরকার, টাইলসের প্যাকেটে তার থেকে সংখ্যায় একটি কম আছে। বিল্ডার্স সম্পূর্ণ নতুন একটি ডিজাইন করেছে। সেক্রেটারি নতুন ডিজাইনটিও ফ্যাক্স করে দিয়েছিল আমাদের মতামতের জন্য।

সমস্যাটা হলো আমার স্ত্রী খুব সুন্দর একটা প্যাটার্ন করেছিলেন যাতে গ্লাস টাইলস্’গুলোর পারস্পরিক সুসামঞ্জস্যতা বজায় থাকে আর তার সঙ্গে জানালার জন্য উপযুক্ত জায়গাও ছিলো। টাইলসের সংখ্যা কম হওয়াতে বিল্ডার্স যে ডিজাইন দিয়েছে সেটি নান্দনিক তো নয়ই, একেবারে হ-য-ব-র-ল। আমার স্ত্রী লিখে পাঠালেন, প্রয়োজনীয় টাইলস্ কিনে নেয়া হোক এবং ওঁর করা ডিজাইন’টিই যেন সম্পূর্ণ করা হয়।

ঘটনাটি খুবই সামান্য তবে সেদিন বিকেলে বেশ গভীর ভাবে ভেবেছিলাম। আমাদের জীবনে কতবার - কতো সময়ে ছোট্ট ছোট্ট জিনিস’গুলোর হারিয়ে যাওয়াতে অনেক পরিকল্পনা নষ্ট করে ফেলতে হয় বা হয়েছে। বিকল্প সবসময় তেমন সুলভ তো নয়, তাই না ?