দামিনীর শ্রীক্ষেত্রে পাইলিন -শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ
অ্যাকোয়ারিয়াম -শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী
প্যারাসাইটস -অনুপম মুখোপাধ্যায়
স্বয়ংসিদ্ধা স্বপ্নরা মিলিয়ে যেতে থাকে দ্রুত -তুহিন দাস
ওয়াহিদা রেহমানের জন্যে -উদয়ন ঘোষচৌধুরি
দারুব্রহ্ম দর্শনদৃপ্ত আঁখি নিমীলনে দামিনী আলুলায়িতা। ব্রা কাপড় কাঁপিতেছিল, হুক খোলা, বায়ুবেগে। ঘুমাইয়া যদ্যপি হ্লাদিনী স্বপ্নোত্থিতান্যায় কতিপয় আসিতেছিল ঘটনাদি। দারুব্রহ্মের পশ্চাতে প্রাকাররুদ্ধ বুদ্ধ। ভূমিস্পর্শমুদ্রা শায়িত। বুদ্ধ-দন্ত ধুম সহযোগে বাদ্যে, গীতে, নৃত্যে শোভিত মুকুন্দদেব রাজা দন্তপুরের শোভাযাত্রা সাজিত। বুদ্ধ, পার্শ্বে বোধিসত্ত্বাদি। জনশ্রুতি ইত্যাদি। পাটলিপুত্রে একদা বিংশতি রথস্থ বুদ্ধ-যাত্রা ফা হিয়েন প্রত্যক্ষে লিপিবদ্ধ। বৌদ্ধ রথযাত্রা জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম যাত্রা একদা।
নাভি শিহরিল। স্তনবৃন্তাদি কঠিন। ফল, ফলিত, ফলাভ্যাং! দামিনী নাভিতে উষ্ণ ওষ্ঠ স্পর্শে শিহরিত। ওষ্ঠ নামিল নিম্নে গভীর উপত্যকায়। নিদ্রাচ্ছন্ন দুই হস্তের অঙ্গুলি দিয়া দামিনী কেশ আঁকড়াইল যাহার, তাহার উদ্দেশে পদদ্বয় ঈষৎ ফাঁক করিয়া সাজিল। সমান্তরাল ত্রিভূজাকারে পদদ্বয় উত্তোলনে স্বস্থাপিতা।
"সে স্থানে নাহিক যমদণ্ড-অধিকার।
আমি করি ভালমন্দ বিচার সবার ।"
কমলাময়ী হান্ডিকা কাষ্ঠাগ্নি দ্বারা তেজঃ কৃত্যে প্রভুপাক করিলেন। দামিনীর শাড়িটি শরীর ছাড়িল। জঘনে হস্তস্পর্শে উত্তাপ, ওষ্ঠ স্ফূরিত হইল ঈষৎ।
"তস্য-অন্নং পাচিতং লক্ষ্যা স্বয়ং ভুক্তাদয়ালুনা।
দত্তং তেন স্বভক্তেভ্যঃ লভ্যতে দেবদুর্লভম্ ।
মহাপ্রসাদ-সংজ্ঞং-চ তৎ পৃষ্ঠং যেদ কেনচিৎ।
যত্র কুত্রাপি বা নীতম্-অবিচারেণ ভুজ্যতে ।"
লবণাক্ত নীলাচল বীচিমালিকার পার্শ্বস্থ জগন্নাথ অধিষ্ঠান স্থান। লক্ষীদেবী স্বহস্তে পাক করিয়া থাকেন প্রভু ভোগ। মহাপ্রসাদ। দামিনী আনিয়াছিল। দীর্ঘ সারির শেষে মন্দির-গর্ভে আরশোলা পরিবেষ্টিত জগন্নাথ দর্শন কুতুহলী দামিনী তৃপ্ত মহাপ্রসাদ দিয়াছিল ফিরিয়া। যে পাইলো তাহার মন্দির প্রবেশ নিষিদ্ধ।
একদা জগন্নাথধাম আক্রান্ত হইয়াছিল। বাংলার মুঘল সুবেদার সুলেইমান কররানি ওড়িষার গজপতি মুকুন্দদেবের সেনাপতি রাজীব লোচন রায় বশ করিতে চাহিল। তাহাকে আমন্ত্রণ করিয়া কন্যাকে দেখাইলো। প্রেম আসিয়াছিল যুবক-যুবতীর। রাজীব লোচন ইসলাম নিতে স্বীকৃত হয় নাই। সুলেইমান-কন্যাকে চাহিল হিন্দু করিতে। মুকুন্দদেব বাধ সাধিলেন। ধর্মান্তরে হিন্দু হইতে পারা নিষিদ্ধ। ক্রোধ রাজীবকে প্রতিশোধস্পৃহার্থী করিল। ইসলাম ধর্ম লইয়া সে ওড়িষার বহু দেবালয় ভূলুন্ঠিত করিল একে একে। জগন্নাথধামও রেহাই পায় নাই। ইসলামধর্মীয়রা জগন্নাথধামে দর্শনপিপাসু হইলেও অনুমতি মিলিবে না। জনশ্রুতি, ইতিহাস মিশ্রণ।
সাইক্লোন পাইলিন আসিবে কল্য। ঝোড়ো হাওয়া উন্মত্ত হইতেছিল। জগন্নাথমন্দিরে প্রবেশাধিকার পায় নাই দামিনী-বান্ধব। ম্লেচ্ছ, অপবিত্র, অনধিকারী। বৌদ্ধ সিদ্ধ ইন্দ্রভূতি জগন্নাথকে বুদ্ধ সম্বোধন করিয়াছেন দীর্ঘকাল পূর্বে। অজস্র সূত্রাদি এরূপ রহিয়াছে।
দামিনী, ইতিহাস অধ্যাপিকা, মহাপ্রসাদ দিয়াছিল নিষিদ্ধকে। কল্য, সাইক্লোন আসিবার পূর্বে নীলাচলে শ্রীক্ষেত্র বিছাইয়া দিয়াছিল। প্রবিষ্ট হইয়াছিল নিষিদ্ধ।
দামিনী ও কালাপাহাড় ও এইরূপ আচরণ কাহিনীজীবি অথবা পাইলিন।
লাল...
নীল...
হলুদ...
সবুজ...
সাদা...
লাল...
নীল...
হলুদ...
সবুজ...
সাদা.........
কাচের ওইপারে যে’সমস্ত পাথর আর গাছালিরা গেরস্ত গড়েছে, তার থেকে চারদিকের চারটি কাচ ইমনকে পৃথক রেখেছে। ইমন ঘরে ফিরে লম্বা হয়ে স্থির চোখে চেয়ে আছে ওদের দিকে, টানা বেশ অনেকটা সময়। লাল... নীল... হলুদ... সবুজ... সাদা... ভাসতে ভাসতে আস্তে আস্তে মাছগুলি ইমনের স্থির চোখের সামনেই বদলে যেতে থাকে দ্রুত। কোনোটা মুখোশ, কোনোটা পকেটঘড়ি, কোনোটা আবার রুপোলী চুলের কাঁটা হয়ে যেতে থাকে। এমনটা রোজই হয় ইদানিং। ইমন হাত নেড়ে গ্যারিঞ্চাকে ডাকে, টেবিলের তলা থেকে একটা লাফ দিয়ে গ্যারিঞ্চা উঠে আসে সোফার উপরে – ইমনের গা ঘেঁষে বসে। ইমন ওকে দু’হাতে তুলে নিয়ে গিয়ে অ্যাকোয়ারিয়ামের সামনে দাঁড়ায় – গ্যারিঞ্চা মৃদু ম্যাঁও দিয়ে মুখ ফিরিয়ে রাখে।
মাঝে মাঝে ইমনের মনে হয় গ্যারিঞ্চা যেন ঠিক বেড়াল নয়। ও যেন অন্য কেউ। হয়ত ও সেই ক্লাস টেনের ছেলেটা যে উল্টোদিকের স্কুলবাড়ির ছাত থেকে পড়ে মারা গিয়েছিল বা ও হয়ত সেই অল্পবয়েসী বিবাহিতা মেয়েটি যে মধ্যরাতে ভাঙা কাঁচের টুকরো কুড়োতো মেঝে থেকে আর তার ফোঁপানি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ত পড়শিরা অথবা গ্যারিঞ্চা হয়ত সেই জোয়ান মদ্দ রিকশাওয়ালাটাও হ’তে পারে যে কিনা রোজ রাত্রে চূড়ান্ত নেশা করে ঘুমিয়ে পড়ত রিকশাটার কোলে আর একদিন শীতের ভোরে বাবার সাথে বাজারে যাওয়ার সময় ছোট্ট ইমন দেখেছিল লোক জড়ো হয়ে আছে রিকশাটার পাশে পড়ে থাকা ওর নিথর মৃতদেহটা ঘিরে। ইমন ঠিক জানেনা। গোটা অ্যাকোয়ারিয়াম জুড়ে তখন ভাসছে ঘড়ি, মুখোশ, চেন, জং-ধরা চাবি, লাইটার... আরও কি কি সব।
ইমন আস্তে আস্তে ঢাকনাটা খোলে, সবজে নীল বুদ্বুদ ওঠা জলের মধ্যে ভালো করে বোঝা যায় না কিছু। সে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনে শাহানা আপা’র দেওয়া পুরোনো খুব চেনা সোনালী লাইটারটা, মা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল একদিন জানলা দিয়ে। বহুদিন বাদে লাইটারটাকে হাতে নিয়ে ওটাকে মনে হল যেন জ্যান্ত। ছটফট করছে। ইমন মনে মনে বলে উঠল “এতদিন কোথায় ছিলেন?” অ্যাকোয়ারিয়াম থেকে ছুটে আসা আলোতে কি ভীষণ ঝিকমিক করছে লাইটারটা! এতদিনের পুরোনো জল থেকে তুলে আনা স্মৃতি – জ্বালালে জ্বলবে কি? ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে কি যেন ভাবতে ভাবতে ইমন একবার চেষ্টা করতেই জ্বলে উঠলো লাইটারটা!
ঠিক তক্ষুনি নিমেষের মধ্যে একটা ঝটকা লাগল ইমনের হাতে। সে তাকিয়ে দেখল গ্যারিঞ্চা আগুন সুদ্ধ গোগ্রাসে ফেয়ে ফেলছে লাইটারটা, মুখে একটা তৃপ্তির রেখা ছড়িয়ে যাচ্ছে ওর।
। প্যারাসাইটস। এই শব্দ থেকেই একটা গল্প কি শুরু! শব্দ যে আমার কাছ থেকে আপনার কাছে যাচ্ছে। শব্দের বায়োগ্রাফি, এমনকি অটোবায়োগ্রাফি, এমনকি অটোমোবাইলে ভ্রমণকাহিনি ... একটা শব্দকে মার্কোপোলো ভাবছি এইমাত্র।
আপনার পাশে শুয়ে আছে নার্গিস। আলট্রাভায়োলেট। সমীপে ন্যস্ত।
আপনার উপরে শুয়ে আছে নার্গিস। আলট্রাভায়োলেট। সমীপে ন্যস্ত।
আপনার নীচে শুয়ে আছে নার্গিস। আলট্রাভায়োলেট। সমীপে ন্যস্ত।
কী আসে যায় ? এই শোবার ঘর কি এয়ারপোর্টের কাস্টমস নাকি, যে কিছু দুষ্টু ফ্যান্টাসি করবেন আপনি! অপূর্ব রূপসীর কুঞ্চনাকুঞ্চন দ্বারা ক্রীড়ারত বিবরটির মধ্যে লুকোনো আছে চরসের হলুদ সম্ভাবনা ... আর আপনি তার সুগন্ধি দায়িত্ব পেয়েছেন। সিক্স প্যাক পুরুষটি তার দন্ডে জড়িয়ে এনেছে হিরের হার, আর আপনাকে ডিকোড করতে হচ্ছে তার ঝিলমিলে প্যাঁচ।
আর আপনি খুব সহজেই একটা আখ্যানকে একটা সিনেমাকে একটা যেকোনো কিছুকে কবিতার ট্যাগ লাগিয়ে দিচ্ছেন। সবকিছুই কবিতা। ক্যামেরাকে তুলিকে কলমকে বানিয়ে দিচ্ছেন চলমান চোখ। এমনকি চরিত্র। যেন চরণসাধন। যেন এই প্রবণতা আপনার স্বধর্মের বাড়া।
একটা গল্পকে কবিতা ভাবাও এক আপত্তিকর পারভার্সন। বৌয়ের হাতে চাবুক বা বরের হাতে দুধ খাওয়ার চেয়ে ঢের বেশি।
বাবু, আপনি স্বেচ্ছাচারী। ভরদুপুরে আপনি ট্র্যাফিক চিরে অনায়াসে অবলীলায় ফুটপাত বদল করেন। কিন্তু উড়ে। তবু হেঁটে। যদিও সাঁতরে।
আপনার ইচ্ছেমতো কোনো শুদ্ধ চরিত্র কখনো ফিঙ্গারিং করে না ঘুমন্ত মনুষ্যে। সে আপনি যতই যতবড়ো ‘আমি’ হোন না কেন।
প্যারাসাইটস। একটা শোবার ঘর। নার্গিসের ফ্ল্যাট যেমন আমার ফ্ল্যাট হয়ে যায়, একই গোপন কিচেন এবং প্রকাশ্য টয়লেট ছাড়াই।
এই আমি কমল। এই আমি যদি একটা আকার চেয়ে নিই ... এই আমি কলমা, না না, কমলা।
আমি লিঙ্গান্তরিত হলাম একটিমাত্র আকারের গুণে।
হায় হরিচরণ!!
আরে এইটুকুই কি নামমাহাত্ম ছাতার সংসারে, চোখ যেমন কান হয়ে যায়, কান হয়ে যায় দো কান ? একটা শব্দ ঢুকে থাকে অনেকগুলো শব্দের ভিতরে ?
আর লজেন্সের মধ্যে একটা ছ্যাঁদা ... যেমন বাড়ছে
বাড়ছে
বাড়ছে
গল্পটা গলে যাক চাইছে না
গল্পটা জমাট বাঁধুক চাইছে না
তবু, আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেই আমার চোখে ঘটনাটা পড়ল, এবং বলেই গল্পটার গাঁড় মারা গেল
পৃথিবীর তিনভাগ জল এক ভাগ স্থল, ফাইভের ভুগোল ছোটো হতে হতে আটত্রিশ পাতায় সেঁধিয়ে যায়। ভুট্টার মাথায় এরকম বড় কিছুই ঢোকেনা। সেদিন সূর্যের ব্যাপারটাও বুঝে উঠতে পারছিলনা। ধুমকেতু বা পৃথিবীর মত এমন বড় কিছুর ধারণাই আসেনা ভুট্টার মাথায়। এমনকি প্রতীক স্যারের ক্লাসে যে গোলোক দেখেছে তার চেয়ে কোনো বড় গোলোক নিজের চোখে দেখেনি ভুট্টা। ক্লাসে প্রতীক স্যার বলেন পৃথিবী পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল পাঁচশ দশকোটি পঞ্চান্ন হাজার পাঁচশ কিলোমিটার প্রায়। ভুট্টাও শুনেছিল ঘর থেকে স্কুলের দুরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার।হেঁটে আসতে কুড়ি মিনিট,বাবার সাইকেলে দশ মিনিট।এই হিসেব এর বাইরে ভুট্টা কিছু বোঝেনা। অথচ পৃথিবীর তিনভাগ জল এক ভাগ স্থল।অন্তু, সোনালী সবাই গড় গড় করে বলে যায়। ভুট্টা বুঝতে পারেনা এসব। জল বলতে বড় জোর মযে যাওয়া ময়ুরাক্ষীকে খুব সামনে থেকে দেখেছে।বন্ধুদের মুখে সমুদ্রের নাম শুনলেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি, অথচ সদরপুকুর! ভুট্টা স্টেশনারী দোকানের কাজ ফেলে ছুটে যায় সদর পুকুরে।মালিকের হুমকি, পয়সা কাটার হুমকি ফেলে ভুট্টা ছুটছে সমুদ্র দেখতে।এখন কি সোনালীর কাছে যাবে? সোনালী দেখেছে কতবড় জল? ভুট্টা নেমে পড়ে পুকুরে। হাত বড় করে আরো বড় করে। আর কত্ত বড় তিনভাগ জল? প্রতীক স্যার বলেছিলেন সমূদ্র একটা বিশাল অ্যাকোরিয়াম। অ্যাকোরিয়ামের ভেতর সবচেয়ে ছোট্ট মাছের মত এক ভাগ স্থল। এ ভাবেই প্লেটোনিক প্লেট নাকি ভেসে থাকে।
ভুট্টা ছোটে ময়ূরাক্ষীর পার পেড়িয়ে সোনালিদের আকোরিয়ামে স্থল দেখতে। আজ হাতে নাতে স্থল দেখাবে প্রতীক স্যার কে। ভুট্টা বন্ধ দরজা পাইপ বেয়ে উঠে পড়ে দোতলায়। সোনালীর মুখস্থ হালকা হালকা ভাসছে প্লেটনিক প্লেটের মতো। “পৃথিবীর ক্ষেত্রফল পাঁচশকোটি পঞ্চান্ন... সোনালী দুলছে দুলছে। ভুট্টার পা এগিয়ে যায় অ্যাকোরিয়ামের দিকে। চোরের মত একটা ছায়া অ্যাকোরিয়ামে, সোনালীর পিছনে এগিয়ে আসে। তখনও পৃথিবীর ক্ষেত্রফল আর সোনালী। সোনালী মাছের নাম ভুট্টার জানা নেই। অ্যাকোরিয়ামে মুখ ঢুকিয়ে খপ করে ধরে ফেলে সোনালী গোল্ডফিশ। সোনালী কেঁপে ওঠে আওয়াজে। সোনালী চেঁচিয়ে ওঠে। ভুট্টা পালাতে গিয়ে অ্যাকোরিয়াম শুদ্ধু মেঝেতে ফেলে যায়। ভেঙে যায় নিমিষে সমুদ্রু। এক ভাগ স্থল কেঁপে কেঁপে স্থির হয়ে যায়। ভুট্টা এসব দ্যাখে। চুপ করে দ্যাখার আগেই পেছন থেকে জোরালো আঘাত ওকে অজ্ঞান করে দ্যায়। ভেঙে যাওয়া সমূদ্র দেখতে দেখতে ভুট্টা ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙলে প্রতীক স্যার বলে চোর। সোনালী বলে চোর। বাবা বলেন চোর। ভুট্টা ডুকরে ওঠে চেঁচিয়ে বলে সমূদ্র ভেঙে গেলে স্থলভাগ মরে যাবে। তোমরা সবাই মরে যাবে। তোমরা সবাই মরে যাবে।
বিদ্যাসাগর শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ করতে হলে ঠিক কতটা বিদ্যা থাকা দরকার? ক্লাস সিক্সের ছেলেটি ঠোঁট চাটল। সন্ধি বিচ্ছেদের ব্যাপারে টিফিনের সময় আলোচনা হয়নি। স্যার চেয়ার টেনে বসলেন হাতে গ্রাম আর বই। মলাটে যার এক খাবলা কমলা সবুজ রঙ। তবে মলাটের রঙ যা-ই হোক না কেন হলুদ বনের কলুদ ফুল বানিয়ে লাস্ট বেঞ্চের বাবলার টিফিন কৌটো ঝেড়ে না দিলে ওর মায়ের বানানো চিঁড়ের পোলাওটা যে জব্বর ছিল সেটা জানাই হত না। চিঁড়ের পোলাও খাওয়ার জন্য সন্ধি লাগে না গায়ের জোড় লাগে। আর বিচ্ছেদ? সেখানেও নো প্রবলেম... পোলাও সাঁটিয়ে গায়ের জোড় এখন দারুন বেড়ে গেছে। বুক চিতিয়ে এগোলেই হল। কিন্তু শুধু এগোলেই তো হবে না বাধ সাধতে রয়েছে ওই গ্রাম আর বই এবং তার মলাটের কমলা হলুদ রং। তাই ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকা সামনে। দৃষ্টি ঘুরছে... ক্যালেন্ডারে, ব্ল্যাক বোর্ডে, ফার্স্ট বেঞ্চে মগ্ন ছেলেটির মাথার খাড়া হয়ে থাকা চারটে চুলে আর স্যারের দুটো ভুরুর মাঝে। নীল বলতে স্কুল ড্রেসের হাফ প্যান্ট আর লাল রয়েছে স্যারের জামার স্ট্রাইপে। বিদ্যাসাগর নেই! রবীন্দ্রনাথ আছেন বটে হেড স্যারের ঘরে। মাইকেল দা দেশে গেল, মায়ের অসুখ। ওদের দেশে হাসপাতাল নেই, সিনেমা হল নেই, ইস্কুল নেই, বদলে একটা গির্জা, একটা মসজিদ আর একটা মন্দির আছে! সাইকেল আছে খান পনেরো সঙ্গে আজীবন ভাগচাষি বরাত। সেখানেও বিদ্যাসাগর নেই! দৃষ্টি ঘুরছে... কড়িকাঠে, ভারতের মানচিত্রে, জানলার গরাদে আর বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের ডগায়। হালকা করে একটা ঢেঁকুর উঠলেও কেউ টের পাবে না। কেউ হাত তুলছে না, ফিসফিস করছে কেউ কেউ। এপিডেমিক কান ফিসফিস খেলা, ছড়িয়ে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে স্যারের মাছি গোঁফ। ঘন ঘন চক্কর দিচ্ছে পাখার পাশে। বাতাস ঠেলে দিল জানলার বাইরে। অচেনা সেজে গিয়ে সে বসল হিন্দি সিনেমার পোস্টারে। দৃষ্টি ঘুরছে... ইট চটা দেয়াল, কমদামী নন এসি হলের টিকিট কাউণ্টার, বুড়ো ভাম টিকিট বিক্রেতা আর আনকোরা প্রেমিকের হাত। মাছিটাকে লক্ষ্য করেনি সে। ক্লাস সিক্সের ছেলেটি লক্ষ্য করছিল সেখানেও বিদ্যাসাগর নেই সন্ধি বিচ্ছেদ ঘটানোর জন্য। কান ফিসফিস খেলা পৌঁছে যাচ্ছে... বিদ্যাসাগর থেকে বিদ্যা বালানে!
এখানে রাত একটায় ঘুমিয়েছি। ছোট ছোট স্বপ্ন দেখেছি তিনটে। আমার মোবাইলে এলার্ম দেয়া ছিলো সাড়ে পাঁচটা। ঘুম ভাঙলো। উঠেই তোমার কথা মনে পড়লো। কারণ শেষ স্বপ্নটা ছিলো একজন এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্মমেকারের। শেষটা নিয়েই গল্প লিখবো ভাবছি। তাই আর ঘুমোচ্ছি না। তোমার কথা মনে হতে ভাবলাম : তুমি বোধহয় অনলাইন। ভাবলাম : শুভ সকাল জানাই। নেটে ঢুকে তোমায় লেখার পর দেখলাম কলকাতার কেউ একজন স্ট্যাটাস দিয়েছে :'ওই তো বৃষ্টি এলো...!' ঠাণ্ডা লাগছিলো, স্বপ্নঘোরে রাতে কখন যে হাঁটুর নিচে দেয়া বালিশটা বুকে উঠিয়ে রেখেছিলাম! জানালার পর্দা সরাই। আকাশ ভেজা। তার সারা গা জুড়ে কেমন বৃষ্টি বৃষ্টি ঘ্রাণ, টিমটিম করে নিভু আলোর মতো জ্বলছে! এমন বৃষ্টির রাত বা শীতের হিম রাতে যন্ত্রণাময় স্বপ্নগুলো দেখি! যদি প্রতিটি লিখতে পারতাম! ঘুম ভেঙে যাবার পরে, এসব স্বয়ংসিদ্ধা স্বপ্নরা মিলিয়ে যেতে থাকে, খুব দ্রুত!
সকালের পাশে পাশে হাঁটছিলাম একা। নির্দোষ বালকের ছন্দে কুড়িয়ে নিলাম একটা গাছের ডাল। ঘোরাতে শুরু করলাম ভাঙা ডালটাকে। ঘোরাতে ঘোরাতে চোখে পড়লো একটা প্রায় গোল পাথর। ক্রিকেট বলের কথা মনে হল। ডালটা ব্যাট। বাউন্ডারি হাঁকানোর ইচ্ছে হল। পাথরটাকে একটু উপরে ছুঁড়ে মারলাম একটা শট। এক মারেই উড়ে গেল বল।
অভিষিক্তা হেঁটে যাচ্ছিলো বাস স্টপের সামনে দিয়ে। বোধহয় কলেজ। ওর পায়ের কাছে গিয়ে সমর্পিত প্রেমিকের মত আস্তে করে পাথরটা মাথা নিচু করে থামলো। ও ঘুরে তাকাতেই দেখলো আমার হাতেই ব্যাট। বললো, “লাগতো যদি?”
বললাম, “লাগেনি তো।”
“যত সব অসভ্যতামি!”
“কী করলাম এমন! তা ছাড়া তোর গায়ে তো লাগেনি পাথরটা।”
একটা ফোন বের করলো অভিষিক্তা। রাজাকে ফোন করে বললো, “দীপাংশু আমাকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছে। এখনই কিছু একটা করো প্লিজ।”
আমি ওকে কিছু বোঝাতে পারছিনা আর। যাই বলি ও আরো মানুষদের ফোন করে আর বলতে থাকে বানানো কথা। পুলিশকে ফোন করে। আমি পাগলের মতো চেঁচিয়ে বলি, “আমি তোকে দেখিনি, তোকে মারতেও চাইনি। তুই কীকরে বলছিস অশ্লীল ভাবে আমি তোর গায়ে পাথর ছুঁড়েছি!”
অভিষিক্তা চলে যায়, শোনে না। আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকলে সবাই আমাকে দেখে নোঙরাভাবে হাসে। কেউ কেউ আমায় ফোন করে ধিক্কার জানায়। আমি সবাইকে সত্যিটা বললেও আর কেউ বিশ্বাস করেনা। নীলাঞ্জনাকে কী বলবো! ও বুঝবে তো?
বাড়ি ঢোকার পথে দেখি পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে গাড়ীসহ। বললো, “তোমায় থানা যেতে হবে।” বললাম, “আমি কিছুই করিনি। পরে যেতে যেতে সব বলছি। একবার বাড়ী থেকে ঘুরে আসতে দিন।” কিছু করিনি তবু দেখছি মা-বাবার সামনে যেতে সাহস পাচ্ছিনা। মা আমার মুখ দেখেই বুঝলো আমি নির্দোষ। বাবাও তাই মানলো। থানা নিয়ে যাওয়া হল। লক্ড আপ করা হল আমাকে। আর নীলাঞ্জনার সাথে যোগাযোগটুকু করা হলো না। হয়তো বেশি ভাববেনা তবু একবার খবর তো নিতে চাইবে। কথা হলে আমায় বিশ্বাস করবে কি?
লক আপেই একজন বমি করেছে। একজন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল বলে হাবিলদার এসে কড়কে গেল। আমি নীলাঞ্জনার কথাই ভাবছি। সারাদিন কেটে গেলে সন্ধ্যেয় ওর বিরক্তিসহ কণ্ঠ শুনতে পেলাম। ভাবলাম আমায় দেখতে এসছে এবার হেভি খিস্তি করে পিছন ফিরে বাড়ী চলে যাবে। না, দেখলাম ওকেও লক আপ করা হচ্ছে। লেডি পুলিশটার উপর চোটপাট করে যাচ্ছে লক আপের মধ্যেও মোবাইল নিয়ে থাকতে দিতে হবে এই নিয়ে। এসে আমায় দেখে আরো তিনগুন জ্বলে চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “তুই? তুই এখানে কেন? উফ্ফ্!!”
কিছুক্ষণ পর আমি গল্পটা বললাম। কিছুই প্রায় পাল্টালো না ওর মধ্যে। মনে হলো সব জানে। পাশে বসে ঢেলে গেল শুধুই বিরক্তি। আমার প্রতিও পৃথিবীর প্রতিও। আমার মনে হয় তবু চাপ লাগছেনা আর। বলেছি সত্যিটা। এমন সময় ওকেই তো দরকার ছিলো। এবার যখন যা হবে দেখা যাবে। নীলাঞ্জনা মাঝে মাঝে বসছে আবার হেঁটে বেড়াচ্ছে। বাকি লোকগুলো ওর দিকে তাকালেই জ্বলে উঠে চেঁচামেচি করছে। আমি আর কিছু বলছিনা।
শান্ত হলে নীলাঞ্জনা বললো, “অভিষিক্তাকে চুমু খাচ্ছিলাম।”
বললাম, “হ্যাঁ তো কী? আগেও তো খেয়েছিস।”
-রাস্তায় খাচ্ছিলাম।
-তাই ধরে নিয়ে এসছে?
-না পুলিশটা ধমক দিয়ে ফিরে গেলো।
-তাহলে?!
-অভিষিক্তা বললো। নীলাঞ্জনা প্লিজ চেঁচিয়ে বল, আমরা চুমু খেতে চাই। চিৎকার করলাম পুলিশটার দিকেই মুখ করে। "আমরা পৃথিবীর সব জায়গায় চুমু খেতে চাই। খাবোও।”
-তারপর তোকে ধরলো? ওকে কিছু বললো না?
-পুলিশটা ফিরে আসতেই অভিষিক্তা আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো, “ও বলেছে। ও মদ খেয়ে আছে।”
তারপর আর আমরা কিছু কথা বলিনি। একে অপরের মধ্যে মাথা গুঁজে বসে আছি অদরকারি জামিনের অপেক্ষায়। তীব্র আলোর ছায়ার মতো রাত ঢুকে আসছে থানার ভিতর।
“আমাকে আপনি চিনবেন না। অবশ্য কাঞ্চনজঙ্ঘাও আমাকে চেনে না। আমার তাতে অসুবিধে নেই। আমি আপনাদের দুজনকেই চিনি। আর এও জানি, আপনাদের দুজনের গায়েই যে গলানো সোনা – তা আমাকে জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। আপনি সেই যে বলছিলেনঃ ‘জানে ক্যা তুনে কহিঁ, জানে ক্যা ম্যায়নে শুনি, বাত কুছ বন হি গয়ী’ – তারপর জানেন, আর কোনও বাত-ই বনল না। চোখের কোল থেকে আপনি হাসলেন। আর আমি ছ্যাঁকা খেলাম আচুলপায়েরপাতা। ওই যে সব্বাই হামলে পড়ে দ্যাখে, ক্যামেরার গা ঘেঁসে আপনার পেছুপেছু চলেছে মন্ত্রমুগ্ধ দুটো পা – ওটা তো আমিই। আপনার নরম দুঃখ মুছতে মুছতে হাঁটছি। ... রেজাল্ট খারাপ হল – বাবা আর পড়াল না। একটা চাকরি জোটালাম। মা জোটাল একটা বৌ। বৌ কপি আনতে বলল, আমি কিনলাম পাটালি। ভাল লাগে, বলুন? হ্যাঁ, ভাল লেগেছিল, তিনবার। বৌ যখনই আঁচল লুটিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে হেসেছে - আমি আপনাকেই ভেবেছিলাম – মাইরি, বিশ্বাস করুন, এই নিয়ে তিনবার ...”
নিয়মভঙ্গের পরদিন তিন ছেলে যখন বাবার পুরনো কাগজপত্তর, পাশবই এইসব ঘাঁটছিল – অ্যাটাচির একটা ছেঁড়া পকেট থেকে এই চিঠিটা বেরিয়ে এসেছিল। ভাঁজে ভাঁজে প্রায় নষ্ট। সঙ্গে একটা হলদেটে সাদা-কালো ছবি।
(* এই অনুগল্পটি পূর্বে ‘আগুনমুখা’(বাংলাদেশ) পত্রিকায় প্রকাশিত। লেখকের অনুমতি অনুসারে পুনরায় প্রকাশ করা হল।)